ট্রান্সফরমারের খুটিনাটি পর্ব-০১


আমরা সকলেই কমবেশী ট্রান্সফরমারের সম্পর্কিত খুটিনাটি জানি। কিন্তু এর গঠনের উপাদান ও ট্রান্সফরমারের প্রকারভেদ অনেকেরই অজানা।
আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ ট্রান্সফরমার গঠনে ব্যবহৃত উপাদান ও ট্রান্সফরমারের প্রকারভেদ।





★ট্রান্সফরমার তৈরি করতে যে সমস্ত জিনিস পত্রের প্রয়োজন তা নিম্নরূপঃ
১। সংকর ধাতুর স্টীলের শিট ( 0.22 mm - 0.35 mm পুরুত্ব এবং 4% সিলিকন মিশ্রিত)।
‎২। ল্যামিনেটেড কোরঃ
‎ (ক) কোল্ড রোল্ড কোর ( cold rolled core) CRGO ( cold rolled grain oriented)
‎ (খ) হট রোল্ড কোর ( hot rolled core) : সিলিকন শিট।
‎৩। ইনসুলেশনঃ বার্নিশ, ফসফেট।
‎৪। ইনসুলেটিং পদার্থঃ লেদার ওয়েট পেপার, কটন, উড, সিল্ক, পেপার, ফাইবার, রেজিন, মাইকা, এজবেসটেস, সিরামিক, বার্নিশ ইত্যাদি।
‎৫। ইনসুলেটিং কপার ওয়্যার বা সুপার এনামেল ওয়্যার, এবং কপার ফ্লাটবার।
‎৬। এম্পিয়ার টিউব।
‎৭। এম্পিয়ার ক্লথ।
‎৮। এইচ.টি ও এ.লটি টার্মিনাল হাউজিং।
‎ (ক) হাইসাইড ও লো সাইড বুশিং।
‎ (খ) ট্যাপ চ্যানজার।
‎ (গ) কনজারভেটর।
‎ (ঘ) ব্রিদার।
‎ (ঙ) ট্রান্সফরমার ট্যানক।
‎ (চ) বুখলজ রিলে।
‎ (ছ) কুলিং ফিন।
‎ (জ) ট্রান্সফরমার ওয়েল।
‎ (ঝ) হাই সাইড ও লো সাইড ওয়াইন্ডিং।
৯। ফর্মা, ট্রান্সফরমার কভার, নাট-বোল্ট ইত্যাদি।
★ট্রান্সফরমারের প্রকারভেদঃ কোর, কয়েল, আকার-আকৃতি, ঠান্ডাকরন এবং ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে ট্রান্সফরমার বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। এদের শ্রেনীবিভাগ নিম্নে দেওয়া হলোঃ
>(ক) কার্যপ্রণালী অনুযায়ীঃ
১। স্টেপ আপ ট্রান্সফরমার।
‎২। স্টেপ ডাউম ট্রান্সফরমার।
>(খ) কোরের গঠন অনুসারেঃ
১। কোর টাইপ ট্রান্সফরমার।
‎২। শেল টাইপ ট্রান্সফরমার।
‎৩। স্পাইরাল কোর টাইপ ট্রান্সফরমার।
>(গ) ব্যবহার বা প্রয়োগ অনুসারেঃ
১। পাওয়ার ট্রান্সফরমার।
‎২। ডিস্ট্রিবিউশন ট্রান্সফরমার।
‎৩। অটো ট্রান্সফরমার।
‎৪। ইনস্ট্রুমেন্ট ট্রান্সফরমারঃ
‎ (ক) কারেন্ট ট্রান্সফরমার।
‎ (খ) পটেনশিয়াল ট্রান্সফরমার।

>(ঘ) শীতলকারন পদ্ধতি অনুসারেঃ
১। স্বাভাবিক বা ন্যাচারাল কুলিং ট্রান্সফরমার।
‎২। উচ্চ চাপযুক্ত বাতাস দ্বারা কুলিং ট্রান্সফরমার।
‎৩। তেলে নিমজ্জিত সেল্ফ কুলিং ট্রান্সফরমার।
‎৪। তেলে নিমজ্জিত পানি দ্বারা কুলিং ট্রান্সফরমার।
‎৫। তেলে নিমজ্জিত চাপযুক্ত বাতাস দ্বারা কুলিং ট্রান্সফরমার।
‎৬। তেলে নিমজ্জিত চাপযুক্ত ঠান্ডা তেল দ্বারা কুলিং ট্রান্সফরমার।
>(ঙ) স্থাপন প্রণালির উপর ভিত্তি করেঃ
১। ইনডোর টাইপ ট্রান্সফরমার।
‎২। আউটডোর টাইপ ট্রান্সফরমার।
‎৩। পোল মাউন্টেড ট্রান্সফরমার।
‎৪। আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রান্সফরমার।
>(চ) ফ্রিকুয়েন্সি অনুযায়ীঃ
১। অডিও ফ্রিকুয়েন্সি ট্রান্সফরমার।
‎২। রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি ট্রান্সফরমার।
>(ছ) ফেজের সংখ্যার উপর ভিত্তি করেঃ
১। সিংগেল ফেজ
‎২। পলি ফেজ।
#প্রশ্নঃ ট্রান্সফরমার এর কোরের মধ্যে ইনসুলেশন বা পাতলা আবরণ কেন ব্যবহার করা হয়?
উত্তরঃ ছোট ট্রান্সফরমারের কোরের মধ্যে আসলে অনেক গুলো (E) এবং (I) এবং বড় সাইজের ট্রান্সফরমারের আলাদা আকৃতির স্টিলের পাত দেখা যায়। আসলে এই প্রতিটি পাতের গায়ে এক প্রকার ভারনিশ/লেমিনেশন পেইন্ট ব্যবহার করা হয়। কারন এতে ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট হওয়ার ভয় থাকে না।
কিন্তু ইন্সুলেশন দেওয়ার প্রধান কারণ হল যাতে একেকটি কোর আলাদা ভাবে থাকতে পারে। তারা যেন একে অন্যের গায়ে লেগে না যায়। এতে তাদের আলাদা আলাদা কোরের রেজিস্টেন্স অনেক কম থাকে বিধায় ভোল্টেজ ড্রপ কম হয়।
যদি কোন ইনসুলেশন ব্যবহার না করা হত তাহলে সবগুলো কোর মিলে একটি বড় সাইজের কোরে পরিণত হতো এবং এর আয়তন বেড়ে যেত। ফলে এর রেজিস্টেন্স ও অনেক বেশি হয়ে যেত। ফলে অনেক ভোল্টেজ ও ড্রপ হত। তাই এই লস ঠেকাতেই ট্রান্সফরমারে ইনসুলেশন ব্যবহার করা হয়।
#প্রশ্নঃ এডি কারেন্ট লস কি?
উত্তরঃ ট্রান্সফরমারের আয়রন লস টা নির্ভর করে ম্যাক্সিমাম ফ্লাক্স ঘনত্ব আর সাপ্লাই ফ্রিকোয়েন্সি এর উপর। যেহেতু ট্রান্সফরমার সব সময় নির্দিষ্ট অর্থাৎ ফিক্সড ফ্রিকোয়েন্সি আর সাপ্লাই ও ফিক্সড তাহলে এখানে কোর ও আয়রন লস প্র্যাক্টিক্যাল যেকোন লোডের জন্যই সমান হয়। অর্থাৎ এখানে আয়রন/কোর লস কন্সট্যান্ট বা অপরিবর্তিত লস হিসেবে গণ্য হয়। আর এটিই মুলত এডি কারেন্ট লস নামে পরিচিত।
#প্রশ্নঃ এডি কারেন্ট লস কিভাবে কমানো যায়?
উত্তরঃ এডি কারেন্ট লস কমাতে চাইলে অবশ্যই কোরের লেমিনেশন গুলো কে যথা সম্ভব পাতলা/চিকন করতে হবে। এবং লেমিনেশন গুলোকে ভালভাবে লেমিনেটিং বা ইনসুলেটিং করা যায় তাহলে এডি কারেন্ট লস অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
#প্রশ্নঃ হিসটেরেসিস লস কিঃ
আমরা জানি ট্রান্সফরমার তৈরি হচ্ছে তড়িৎ চৌম্বকীয় বস্তু যেমন লোহা, ফেরাইট কোর প্রভৃতি দ্বারা। এখন এই ট্রান্সফরমার যখন কোন অল্টারনেটিং কারেন্টের দ্বারা বারবার ম্যাগনেটাইজ ও ডি-ম্যাগনেটাইজ করা হয় তখন এর অভ্যন্তরে থাকা অণু বা কোর ম্যাটেরিয়াল গুলো বারংবার দিক পরিবর্তন করতে থাকে। এই দিক পরিবর্তনের ফলে কিছু শক্তি তাপ হিসাবে নির্গত হয় যা কোন কাজে লাগে না। একেই হিসটেরেসিস লস বলে।
এখানে উল্লেখ্য যে এই হিসটেরেসিস লস শুধু যে ট্রান্সফরমারেই হয় তা কিন্তু নয়। মোটর, জেনারেটর, ফ্যান থেকে শুরু করে যেখানেই কোন কয়েল কে চৌম্বকীয় বস্তুর উপর প্যাঁচানো হয় সেখানেই হিস্টেরেসিস লস দেখা যায়। তবে জেনারেটর আর ট্রান্সফরমার এ এই হিস্টেরেসিস লস টি বেশি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়।
#প্রশ্নঃ স্টেপ আপ ট্রান্সফরমার কাকে বলে?
যে ট্রান্সফরমারের প্রাইমারীতে ভোল্টেজ দিলে সেকেন্ডারীতে উচ্চ ভোল্টেজ পাওয়া যায় তাকে স্টেপ আপ ট্রান্সফরমার বলে। আমরা ইউপিএস, আইপিএস, ইনভার্টার প্রভৃতি যন্ত্রপাতিতে যে ট্রান্সফরমার ব্যবহার করে থাকি সেগুলো স্টেপআপ প্রকৃতির ট্রান্সফরমার।
#প্রশ্নঃ স্টেপ ডাউন ট্রান্সফরমার কাকে বলে?
যে ট্রান্সফরমার এর প্রাইমারীতে ভোল্টেজ দিলে সেকেন্ডারীতে অপেক্ষাকৃত নিম্ন ভোল্টেজ পাওয়া যায় তাকে স্টেপ ডাউন ট্রান্সফরমার বলে। বেশীরভাগ ঘরের যন্ত্রপাতি যা আমরা ব্যবহার করি সেগুলোর ভেতরে স্টেপ ডাউন ট্রান্সফরমারই ব্যবহার করা হয়।
#প্রশ্নঃ কিভাবে একটি স্টেপ আপ ট্রান্সফরমার কে স্টেপ ডাউন করবো?
উত্তরঃ যদি আমরা কোন ট্রান্সফরমার কে স্টেপআপ করতে চাই তাহলে ট্রান্সফরমারের প্রাইমারী কয়েলের প্যাঁচ সংখ্যার তুলণায় সেকেন্ডারী কয়েলের প্যাঁচ বেশি করতে হবে। আর এই প্যাঁচ সংখ্যা নির্ণয় করতে হলে আমাদের কে ট্রান্সফরমারের প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল জানতে হবে এবং সূত্রানুযায়ী ট্রান্সফরমারের প্রাইমারী ও সেকেন্ডারী কে প্রয়োজন মত প্যাঁচ দিয়ে নিতে হবে।
#প্রশ্নঃ ট্রান্সফরমার রেশিও বলতে কি বুঝায়?
ট্রান্সফরমারের প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি কয়েলের ভোল্টেজ, প্যাঁচ সংখ্যা ও কারেন্টের মধ্যে যে সম্পর্ক থাকে, তাকে ট্রান্সফরমারের ট্রান্সফরমেশন রেশিও বলে। একে নিম্নোক্ত ভাবে প্রকাশ করা যায়-
Vp⁄Vs = Np⁄Ns = Is⁄Ip
এখানে,
• Vp = প্রাইমারী ভোল্টেজ
• Vs = সেকেন্ডারী ভোল্টেজ
• Np = প্রাইমারী প্যাঁচ সংখ্যা
• Ns = সেকেন্ডারী প্যাঁচ সংখ্যা
• Ip = প্রাইমারী কারেন্ট
• Is = সেকেন্ডারী কারেন্ট
নিচের চিত্রটি লক্ষ্য করলে বুঝতে সুবিধা হবে আশাকরি-
#প্রশ্নঃ কোন ট্রান্সফরমার এর এফিসিয়েন্সি কখন ম্যাক্সিমাম হয়?
উত্তরঃ যখন আয়রণ লস ও কপার লস প্রায় সমান হয় তখনই ওই ট্রান্সফরমারের ইফিসিয়েন্সি ম্যাক্সিমাম হতে পারবে।
#প্রশ্নঃ ট্রান্সফরমার ঠান্ডা রাখার সবচেয়ে জনপ্রিয় বা ব্যবহৃত উপায় কি?
উত্তরঃ অয়েল কুলিং বা তেল দিয়ে করা হয়। এ ছাড়াও হাল আমলে এয়ার কুলিং, নাইট্রোজেন কুলিং, ওয়াটার কুলিং প্রভৃতিও ব্যবহার করা হয়।
#প্রশ্নঃ লিকেজ ফ্লাক্স কি?
উত্তরঃ আমরা জানি ট্রান্সফরমার মিউচুয়াল বা কমন ইন্ডাকটেন্স এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে। এখন, লিকেজ ফ্লাক্স বলতে বুঝায় প্রাইমারী ও সেকেন্ডারী কয়েলের যে ফ্লাক্স উৎপন্ন হয়। আর আরেকটি কথা হল যদি সেকেন্ডারি কয়েলের ফ্লাক্সের পরিমাণ প্রাইমারী এর চেয়ে বেশি হয় তাহলে আউটপুটেও স্বাভাবিকের চেয়ে কম ভোল্টেজ উতপন্ন হবে।
#প্রশ্নঃ ট্রান্সফরমার কোর কি দিয়ে তৈরি হয়?
উত্তরঃ আসলে ট্রান্সফরমারের কোর গুলো নরমাল স্টেনলনেস স্টিল দিয়ে হয় না। এটার জন্য #সিলিকন #স্টিল নামক একধরনের স্টিল এর পাত ব্যহার করা হয় যা বাজারে পাওয়া যায়। তবে আসল নকল এর ও একটা বিষয় কিন্তু সব জায়গাতেই আছে।
#প্রশ্নঃ ট্রান্সফরমারের কোরের লেমিনেশন/ইনসুলেশন কতটুকু পুরু হয়ে থাকে?
উত্তরঃ আসলে এই লেমিনেশন স্বাভাবিক ভাবে ০.৪মিমি থেকে ০.৫ মিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে পাওয়ার লাইনে ব্যবহৃত অনেক ট্রান্সফরমারের লেমিনেশনের পুরুত্ব অনেক কম হয় (০.২ মিমি)।
#প্রশ্নঃ একটি ট্রান্সফরমার কয়েল এর তার গুলো কি মানের হতে হবে?
উত্তরঃ একটি ট্রান্সফরমারের প্রাইমারী এমং সেকেন্ডারী কয়েল অনেক ভাল মানের অরিজিনাল কপার তার দিতে তৈরি করতে হবে।তাছাড়া এটার মধ্যে দিয়ে অতিরিক্ত রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়,ফলে ভোল্টেজ ড্রপ বেশি হয়,লসের পরিমাণ বেড়ে যায়।
আজ এইটুকুই, আমাদের লেখা তখনই স্বার্থক হবে যখন আপনারা কিছু শিখতে পারবেন। লাইক, কমেন্ট করুন। এতে আমরা লিখতে অনুপ্রাণিত হই। কমেন্ট সেকশনে পোষ্ট সম্পর্কিত যেকোনো প্রশ্ন করতে পারেন। আমাদের পোষ্ট গুলো নিয়মিত দেখতে পেজের ফলোয়িং অপশনে সি ফার্স্ট ক্লিক করুন। আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ
Azadur Rahman Azad Sir💓💓💓

No comments

Powered by Blogger.